Ans:-
ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরন নীতি:-
ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরন নীতির মূল অর্থ হলো সরকারের তিনটি বিভাগ যথা আইন বিভাগ, শাসন বিভাগ এবং বিচারবিভাগ এবং প্রাচীনকালে এই তিনটি বিভাগ একই ব্যক্তির হাতে ব্যস্ত থাকার কারণে অনেক সময় বিচার এর নামে প্রহসন হত তাই অষ্টাদশ শতাব্দীতে সার্বভৌমত্ব কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে ক্ষমতা বিভাজ নীতি চালু করা হয়।
অর্থাৎ যেকোনো স্বাধীন রাষ্ট্রের সরকারের তিনটি বিভাগ স্বতন্ত্রভাবে নিজ নিজ কার্যসম্পাদন করে থাকে তাকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পরিভাষায় ” Theory of Separation of Power” বা ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরন নীতি বলে।
মূল কথা:-
ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরন নীতির মূল কথা হলো—
i. সরকারের যে বিভাগের যা কাজ সেই বিভাগকে সেটাই করা দরকার।
ii. এক বিভাগের কাজ অন্য বিভাগকে করা উচিত নয়।
iii. এক বিভাগের কাজ অন্য বিভাগের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হওয়া উচিত নয়।
iv. একই ব্যক্তি একাধিক বিভাগের সঙ্গে যুক্ত থাকা উচিত নয়।
নীতির সমর্থকগণ:-
অষ্টাদশ শতাব্দীর খ্যাতনামা রাষ্ট্রবিজ্ঞানী মন্তেস্কু ১৭৪৮ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত ” The Spirit of Laws ” গ্রন্থে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকর নীতি কে বলিষ্ঠ মতবাদ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন।
এছাড়া ম্যাকিয়াভেলির শিশুরও পলিভিয়াস, সিসের, বোদা প্রমুখ এই নীতিকে সমর্থন করেছেন।
বাস্তব প্রয়োগ:-
আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র, আর্জেন্টিনা, মেক্সিকো, ব্রাজিল, চীন, প্রভৃতি দেশে এই নীতির প্রয়োগ লক্ষ্য করা যায়।
ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকর নীতির পক্ষে যুক্তি:-
ক্ষমতার স্বতন্ত্রীকর নীতির পক্ষে যুক্তিগুলি হল —
i. বিভাগীয় স্বাধীনতা সংরক্ষণ:-
এই নীতির প্রয়োগের মাধ্যমে সরকারের তিনটি বিভাগ আলাদা আলাদা ভাবে কাজকর্ম পরিচালনায় একে অপরের কে হস্তক্ষেপ করতে পারবেনা, ফলে বিচার বিভাগীয় স্বাধীনতা রক্ষিত হয়।
ii. স্বৈরাচারিতা রোধ:-
ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরন নীতির প্রয়োগের ফলে সরকারের তিনটি বিভাগের মধ্যে কোন একটি বিভাগ নির্দিষ্ট বিভাগের হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভবন ঘটে না এবং প্রতিটি বিভাগের সমমর্যাদা সম্মুখীন ও তার অধিকারী হওয়ায় কোন একটি বিভাগের স্বৈরাচারী হয়ে ওঠার সম্ভাবনা থাকে না।
iii. কর্মকৌশলতা ও দায়িত্বশীলতা বৃদ্ধি:-
এই নীতি প্রয়োগের ফলে তিনটি বিভাগ স্বাধীনভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করতে পারে। এর ফলে প্রত্যেকটি বিভাগের দায়িত্বশীলতা বৃদ্ধি পায় এবং বিভাগের কাজ নির্দিষ্ট থাকায় কর্ম কুশলতাও বৃদ্ধি পায়।
iv. ব্যক্তির স্বাধীনতা রক্ষা:-
মন্তেস্কুর মতে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরন নীতির প্রয়োগের ফলে ব্যক্তির স্বাধীনতা রক্ষিত হয় কারণ ক্ষমতা একই ব্যক্তি বা বিভাগের হাতে কেন্দ্রীয় ভোট থাকে না।
ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির বিপক্ষে যুক্তি:-
সেবাইন গিলক্রিস্ট প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ক্ষমতার স্বতন্ত্রীকরণ নীতিকে সমর্থন করেনি। এই নীতির বিপক্ষে যুক্তি গুলি হল —
i. বাস্তব প্রয়োগ অসম্ভব:-
সমালোচকদের মতে এই নীতির বাস্তব প্রয়োগ সম্ভব নয় কারণ আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র সরকারের তিনটি বিভাগের পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে সরকার পরিচালিত হয়। তাই এই নীতির প্রয়োগ হলে প্রত্যেকটি বিভাগ স্বৈরাচারী হয়ে উঠবে এবং ব্যক্তির স্বাধীনতার পক্ষে বিপদজনক হয়ে উঠতে পারে।
ii. জৈব মতবাদ:-
জৈব মতবাদীরা এই নীতির কঠোরভাবে সমালোচনা করে সরকারকে জীবদেহের সঙ্গে তুলনা করেছেন কারণ জীবদেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ গুলি যেমন পারস্পরিক বিচ্ছিন্ন হয়ে কাজ করতে পারে না তেমনি সরকারের তিনটি বিভাগ আলাদা আলাদা ভাবে সাফল্যের সঙ্গে কাজ করতে পারে না।
iii. দায়িত্বহীনতা:-
সরকারের প্রতিটি বিভাগ স্বতন্ত্র ভাবে কাজ করলে নিজেদের দায় অপর্বিভাগ এর ওপর চাপানোর চেষ্টা করতে পারে, ফলে জাতীয় স্বার্থ ক্ষুন্ন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
iv. জনকল্যাণ প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি:-
আধুনিক কল্যাণকামী রাষ্ট্রের সরকারকে বিভিন্ন জনকল্যাণমুখী কাজকর্ম করতে হয়। কিন্তু এই নীতি প্রয়োগের ফলে নিজেদের মধ্যে পারস্পরিক ঐক্য নষ্ট হয়ে যাওয়ায় জনস্বার্থ জড়িত কল্যাণ মূলক কাজ ব্যাহত হবে।
মূল্যায়:-
পরিশেষে বলা যায় যে কিছু দোষ ও ত্রুটি থাকার সত্বেও এই নীতির গুরুত্বকে অস্বীকার করা যায় না। কারণ সচেতন ভাবে এই নীতিটি সরকারি কাজকর্মের সাফল্য আনতে পারে, জনগণের অধিকার ও স্বাধীনতাকে সুনিশ্চিত করতে পারে এবং রাষ্ট্রীয় শৃঙ্খলা ও সংহতি কে সুরক্ষিত করতে পারে। তাই এই নীতি বর্জনমূলক নয় সজাগ ও সচেতন ভাবে প্রয়োগ করায় একান্ত কাম্য।
[postx_template id=”1679″]