ভূমিকা:-
প্রাক উপনিবেশিক শাসন পর্বে ভারতে হস্ত কুটির শিল্পজাত সামগ্রী ছিল যথেষ্ট উন্নতমানের। বাংলার সুতি ও রেশম, বস্ত্র শিল্প এবং শট শিল্প ছিল উল্লেখযোগ্য। এছাড়া বারণসি, সুরাট, লখনও, আগ্রা, মুলতান ছিল সুতি শিল্পের কেন্দ্র। পাশাপাশি লোহা, তামার, রূপো,সর্ণ, শিল্পেও ভারত ছিল উন্নত। কিন্তু ওপনিবেশিক শাসন পর্বে এই শিল্প গুলি ক্রমশ ধ্বংস হয়ে পড়ে। যা ইতিহাসের পাতায় অবশিল্পায়ন নামে পরিচিত। অর্থাৎ অবশিল্পায়ন কথার অর্থ হলো শিল্পের অবনমন বা অধগতি।
অবশিল্পায়নের কারণসমূহ:-
উপনিবেশিক শাসন পর্বে ভারতে অবস্থিত আইনের কারণগুলি ছিল —
১.কোম্পানির একচেটিয়া বাণিজ্য:-
১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে পলাশীর যুদ্ধের পর বাংলার ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ইংরেজ কোম্পানির একচেটিয়া বাণিজ্যিক অধিকার। কিন্তু কোম্পানির কর্মচারীরা দস্তকের অপব্যবহার করে ও বিনা সুলকে বাণিজ্য করায় ভারতীয় শিল্পী ও কারিগররা অত্যন্ত অসন্তুষ্ট হয়ে পড়ে।
২. শিল্প বিপ্লব:-
অষ্টাদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে ইংল্যান্ডে শিল্প বিপ্লব ঘটলে ইংল্যান্ডের কলকারখানায় উৎপাদিত উন্নত মানের ও সস্তা দ্রব্য সামগ্রী বিক্রির জন্য ভারতের বাজার কে বেছে নেওয়া হয়।
৩. অবাধ বাণিজ্য নীতি:-
১৮১৩ খ্রিস্টাব্দে চার্টার অ্যাক্ট আইনের মাধ্যমে অবাধ বাণিজ্য নীতি প্রবর্তিত হয়। এবং কোম্পানির একচেটিয়া অধিকার নষ্ট হয়। আবার ১৮৩৩ সালে চার্টার আইনে ভারতীয় বাজার ব্রিটিশ পণ্যের জন্য পুরোপুরি উন্মুক্ত করা হলে অবশিল্পায়ন পরিপূর্ণভাবে প্রসার লাভ করে।
৪.বৈষম্যমূলক শুল্ক নীতি:-
কোম্পানি যে বৈষম্যমূলক শুল্ক নীতি গ্রহণ করেছিল। তার ফলে ভারতীয় পণ্য সামগ্রী ইংল্যান্ডের কারখানায় উৎপাদিত পণ্য সামগ্রীর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারেনি।
৫.দেশীয় রাজন্য বর্গের পৃষ্ঠপোষকতার অভাব:-
ইংরেজ কোম্পানি সাম্রাজ্য বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে দেশীয় রাজাদের ক্রমশ ক্ষমতা চ্যুত হতে থাকে ফলে দেশীয় শিল্প দ্রব্যের প্রতি দেশীয় রাজন্য বর্গের পৃষ্ঠপোষকতার অভাব দেখা দেয়।
৬.প্রযুক্তি ও মূলধনের দ্বন্দ্ব:-
ইংল্যান্ডে মূলধন আধুনিক যন্ত্র ও প্রযুক্তি ব্যবস্থার মাধ্যমে উৎপাদন প্রক্রিয়াকে আরো উন্নত করে কিন্তু ভারতের উৎপাদন ব্যবস্থায় সে প্রাসাদ পদতা থেকে যায়। ফলে ভারতের পুরাতন প্রযুক্তির ব্যবস্থা ইংল্যান্ডের উন্নত মানের প্রযুক্তির ব্যবস্থার কাছে টিকতে পারেনি।
অবশিল্পায়নের ফলাফল:-
১. বেকারত্ব:-
দেশীয় কুটির শিল্প ধ্বংসের ফলে ভারতে বিপুল শঙ্খ হস্তশিল্পী ও খারিগরিরা নিজের কাজ হারিয়ে ফেলে বেকার হয়ে পড়ে। নরেন্দ্র কৃষ্ণ সিংহের মতে শুধুমাত্র বাংলাতেই ১০ লক্ষ মানুষ তার কাজ হারায়।
২. জমির উপর চাপ বৃদ্ধি:-
বেকার শিল্পী ও কারিগরেরেরা কোন কর্মসংস্থানের সুযোগ না পেয়ে কৃষির উপর নির্ভর হয়ে পড়লে জমির উপর চাপ বাড়ে।
৩. কাঁচামাল রপ্তানি কারক দেশ:-
অবশিল্পায়নের ফলে ভারত একটি কাঁচামাল রপ্তানি কারক দেশে পরিণত হয়। যা ভারতকে একটি শিল্প প্রধান দেশ থেকে কৃষি প্রধান দেশে পরিণত করে।
৪. দারিদ্রতা বৃদ্ধি:-
শিল্প বাণিজ্য ধ্বংসের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতি ধ্বংস হলে ভারত একটি দরিদ্র দেশে পরিণত হয়। দরিদ্রতা দুর্ভিক্ষ মহামারী ভারতীয় জীবনে নৃত্য সঙ্গী হয়ে ওঠে।
উপসংহার:-
জাতীয়তাবাদী নেতা রমেশ চন্দ্র দত্ত বলেছেন কুটির শিল্প ধ্বংস ভারতের ইতিহাসে সবচেয়ে দুঃখজনক অধ্যায়। যাইহোক অবশিল্পায়নের ফলে ভারতের কুটির শিল্পী গান বেকার হয়ে পড়ে এবং ভারতীয় অর্থনীতিতে সংকটপূর্ণ অবস্থার সৃষ্টি হয় তা স্পষ্টভাবেই বলা যায়।