পেশাদারী ইতিহাস:-
সমাজবিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখা হিসাবে ধরা হয় ইতিহাসকে। ইতিহাস চর্চার মধ্য দিয়ে যেমন মানব সভ্যতার অতীতকাহিনী জানা যায় তেমনি মানব সভ্যতার অতীত অভিজ্ঞতা থেকে বর্তমান কালের পুনর্মূল্যায়ন করা যায়। তবে এই ইতিহাস যখন ভাবাবেগ কল্পনার পক্ষপাতিকে বর্জন করে যুক্তিবাদ ও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিকে মূলধন করে প্রামাণ্য তথ্যের ওপর ভিত্তি করে উনিশ শতকের শেষ দিকে ইতিহাস চর্চার যে সূচনা হয় তাই হলো পেশাদারী ইতিহাস।
পেশাদারী ইতিহাস চর্চায় বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উপর দৃষ্টি দিতে হয়, যেমন —
i. ইতিহাসের তথ্য সংগ্রহ করা এবং তথ্যগুলি যাচাই করা।
ii. ঐতিহাসিক ঘটনার কালাম বজায় রাখা।
iii. কোন ঐতিহাসিক ঘটনা পরম্পরা ও তার কার্যকরণ সম্পর্ক নির্ণয় করা।
iv. এছাড়া ইতিহাসবিদদের যুক্তিবাদী মনোভাব, নিরপেক্ষতা ও বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি থাকা একান্ত প্রয়োজন। তা না হলে ইতিহাস চর্চা সম্পূর্ণ হয় না।
পেশাদারী ইতিহাস বনাম অপেশাদারী ইতিহাস:-
পেশাদারী ইতিহাসের সঙ্গে অপেশাদারী ইতিহাসের সঙ্গে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে পার্থক্য লক্ষ্য করা যায় , যেমন–—
i. মৌখিক ইতিহাস:- পৌরাণিক কাহিনী, কিংবদন্তি, লোককথা, স্মৃতি কথা, ইত্যাদি চর্চায় এই ধরনের ঐতিহাসিক উপাদানের গুরুত্ব কম কারণ এতে বিজ্ঞানী দৃষ্টিভঙ্গির অভাব স্পষ্ট। যদিও অপেশাদারী ইতিহাস চর্চার ক্ষেত্রে মৌখিক ইতিহাস বা জনশ্রুতির গুরুত্ব অপরিসীম।
ii. নিরপেক্ষতা:- পেশাদারী ইতিহাস চর্চার একটি বিশেষ দিক বা গুন হল নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি। ফলে কোন ঐতিহাসিক ঘটনা বা কাহিনী বর্ণনার ক্ষেত্রে ধর্মীয় ও রাজনীতিক ভাবে পক্ষপাত দুষ্ট হয় না। কিন্তু অপেশাদারী ইতিহাস চর্চায় এই ক্ষমতি দেখা দেয়। ইতিহাসবিদরা তাদের ব্যক্তি কেন্দ্রিক মানসিকতার দ্বারা পরিচালিত হয়ে ইতিহাসের ঘটনার জাল বোনেন ।
iii. তথ্যানু সন্ধানী মনোভাব:- পেশাদারী ইতিহাস চর্চায় ইতিহাসবিদরা সঠিক তথ্য অনুসন্ধান করে। ইতিহাসের পাতায় লিপিবদ্ধ করেন এর ফলে পেশাদারী ইতিহাস সঠিক তথ্য নির্ভর ও যুক্তিগ্রাহ্য। কিন্তু অপেশাদারী শাখায় এই রূপ দৃষ্টিভঙ্গির অভাব থাকে। তার ফলে কোন ঐতিহাসিক ঘটনা বা কাহিনী তথ্য নির্ভর ও যুক্তিগ্রাহ্য হয় না।
iv. আকর তথ্য সংগ্রহ:- পেশাদারী শাখায় আকর তথ্য (Primary Source) এর উপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়। কারণ এই তথ্য দ্বারা ইতিহাসবিদগণ কোন ঐতিহাসিক ঘটনার সত্যতা প্রমাণ করেন বা সত্যের কাছাকাছি পৌঁছাতে পারেন । এক্ষেত্রে তারা আকর তথ্যগুলি যাচাই করেন কিন্তু অপেশাদারী শাখায় এই মনোভাবের অভাব দেখা দেয়।
v. স্বাধীন চিন্তা:- পেশাদারী ইতিহাস রচনার ঐতিহাসিক জ্ঞান যুক্তি ও চিন্তার দ্বারা ঘটনার ব্যাখ্যা দান করেন কিন্তু অপেশাদারী ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে ইতিহাসবিদদের সেই দায়বদ্ধতার অভাব থাকে।
উপসংহার:-
পরিশেষে বলা যায় ঐতিহাসিক মানব সমাজের বাইরে কোন জীব নন। স্বভাবতই ব্যক্তি ঐতিহাসিকের সংস্কার, ধর্ম, বিশ্বাস, মানসিকতা ও রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি তার লেখনীকে প্রভাবিত করে। তার ফলে পেশাদারী ইতিহাস চর্চার ছন্দপতন হয়।