ভূমিকা:-
১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে স্বাধীনতা লাভের পর ভারতে নবগঠিত সরকার বহুমুখী সমস্যার সম্মুখীন হয়। প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ প্রশান্ত চন্দ্র মহালানবিশ ভারতে প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুর অর্থনৈতিক চিন্তাভাবনার সঙ্গে একমত হয়ে অর্থনৈতিক ও সামগ্রিক উন্নয়নের প্রয়োজনে পাঁচটি নির্দিষ্ট অর্থনৈতিক পরিকল্পনার কথা বলে। মহালানবিশ প্রস্তাব অনুসারে কংগ্রেস সরকার ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে থেকে গঠিত 5 বছর অন্তর সোভিয়েত রাশিয়ার অনুসরণে পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা গ্রহণ করেন।
প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা (1951-56 খ্রিঃ):-
স্বাধীনতা লাভের পর থেকে ভারতে যে বহুমুখী অর্থনৈতিক সমস্যার সম্মুখীন দেখা দিয়েছিল তা দূর করার জন্যই অনেক চিন্তা ভাবনায় সেই উদ্দেশ্যে ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়।
উদ্দেশ্য:-
এই পরিকল্পনার প্রধান লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য গুলি ছিল —
i. খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি করা।
ii. ভারতের প্রকৃত কাঁচামাল ও খনিজ সম্পদকে পর্যাপ্ত পরিমাণে ব্যবহার করা।
iii. মুদ্রা নীতির চাপ হ্রাস করা।
iv. জাতীয় সড়ক রেলপথ ও সেচ ব্যবস্থা ও জল বিদ্যুৎ ও তাপ শক্তির উৎপাদন করা।
v. ব্যক্তির আয় ও সম্পদের মধ্যে অসমতা রাস করা।
গুরুত্ব:-
i. প্রথম পঞ্চম বার্ষিকী পরিকল্পনা ছিল নবগঠিত সরকারের একটি সাহসী পদক্ষেপ।
ii. প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার শেষে ভারতীয় জাতীয় আয় ১৮% বৃদ্ধি পায়।
iii. দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সম বৃদ্ধস্থ প্রায় 430 মাইল রেললাইনের সাথে আরো ৩৮০ মাইল সংযুক্ত হয়।
iv. সেচ বিদ্যুৎ ও যোগাযোগ ব্যবস্থায় উন্নয়নের পাশাপাশি প্রায় ৪৫ লক্ষ লোকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা।
দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা (1956-61খ্রিঃ):-
প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় মোটামুটি সাফল্য লাভের পর অর্থনীতিবিদ প্রশান্ত চন্দ্র মহলানবিশের উদ্যোগে ও জহরলাল নেহেরুর সক্রিয়তায় দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা গড়ে ওঠে। এই কারণে এটি ‘নেহেরু মহলানবীস মডেল‘ নামে পরিচিত।
উদ্দেশ্য:-
i. ভারতের প্রাথমিক ও মূল শিল্পগুলির উন্নতির মধ্য দিয়ে অন্যান্য ক্ষুদ্র শিল্পের দ্রুত উন্নতি ঘটানো।
ii. জীবন যাত্রার মান উন্নয়নের উদ্দেশ্যে জাতীয় আয় বৃদ্ধি করা।
iii. শ্রমনির্ভর ক্ষুদ্র শিল্প স্থাপনের মাধ্যমে বিপুল সংখ্যক শ্রমজীবী মানুষকে কর্মমুখী করে তোলা।
iv. বার্ষিক উৎপাদনের হার ৫% বৃদ্ধি করা।
v. জাতীয় ও বন্টন নীতির মধ্য দিয়ে বৈষম্য হ্রাস করা ইত্যাদি।
গুরুত্ব:-
i. এই পরিকল্পনায় জাতীয় আয় কুড়ি পার্সেন্ট বৃদ্ধি পায়।
ii. খাদ্যের উৎপাদন ১৫% বৃদ্ধি হয়েছিল।
iii. ভারী ইঞ্জিনিয়ারিং ও যন্ত্র নির্মাণ শিল্পের সূচনা হয়।
iv. দুর্গাপুর, ভিলাই ও রাও কেল্লাই ইস্পাত কারখানা স্থাপিত করা।
তৃতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা:-
প্রথম দুটি পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার মত তৃতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা শুরু হলেও তা ব্যর্থ হয়। চীনের ভারতে আক্রমণ ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে ভারত, পাকিস্তান যুদ্ধ ১৯৬৫ থেকে ৬৬ খ্রিস্টাব্দে ব্যাপক খরা ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দে প্রাকৃতিক ঘটনা এই ব্যর্থতার জন্য বিশেষভাবে দায়ী ছিল।
উদ্দেশ্য:-
i. প্রতিবছর জাতীয় আয় ৫% বাড়ানো।
ii. খাদ্য উৎপাদনের স্বনির্ভরতা অর্জন করা।
iii. কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি করা।
iv. বৈষম্য দূর করে অর্থনৈতিক ক্ষমতার সুসম বন্টন করা।
গুরুত্ব:-
i. এই পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় মাথাপিছু আয় তার লক্ষ মাত্রাকে স্পর্শ করতে পারেনি।
ii. কৃষি ক্ষেত্রে সূচনীয় ব্যর্থতা দেখা দেয়।
iii. ইস্পাত ,সিমেন্ট, বিদ্যুৎ উৎপাদনের আশানুরূপ ফল পাওয়া যায়নি।
উপসংহার:-
প্রথম তিনটি পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার মূল্যায়নে বলা যায় ওই পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় মধ্য দিয়ে ভারতে মিশ্র অর্থনৈতিক সূচনা হয়। যদিও সমস্ত পরিকল্পনা তার লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছাতে পারেনি, তবুও এই অর্থনৈতিক পরিকল্পনার গুরুত্বকে অস্বীকার করা যায় না। কেননা পরিকল্পনা গুলির মধ্য দিয়ে ভারতবর্ষ স্বাধীনভাবে তার অর্থনৈতিক উন্নয়নের ব্যাপারে সচেষ্ট হয়েছিল।